আমেরিকার সিস্টেমেটিক রেসিজম ও ভারতের বিভাজননীতি

টনি মরিসন পড়ছিলাম।  দ্য ব্লুয়েস্ট আইজ।  সেখানে একটি কালো মেয়ে, নাম পেকোলা, নীল চোখ চায়।  কারণ সে মনে করে, নীল রঙের মায়া বড় সাংঘাতিক।  ফর্সা ত্বক এবং নীল চোখ এই হল সৌন্দর্যের মাপকাঠি।  সে ভাবে, সাদা মেয়েদের নীল চোখে কী ভালো লাগে।  সে সাদা হতে পারবে না কিন্তু নীল চোখ পেলে ভারী খুশি হবে।  কিন্তু তাকে নীল চোখে ভালো লাগবে কী? চির সন্দেহ।  আমি মানানসই হব তো ? আমাকে মেনে নেওয়া হবে তো? এই হল সমস্যার শুরু।  যা কিছু কনভেনশনের বাইরে, সেই সবকিছুই গ্রহণযোগ্য নয়।  এই মানসিকতা থেকেই বিভাজনের শুরু।  যা কিছু আমার মত নয়, তার সাথে সহাবস্থান নৈব নৈব চ।  এবং সামাজিক বায়নারিতে যে প্রিভিলেজড সে দমন করে আর যে নয় সে অবদমিত।  উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারে, ১৯৫০-এর দশকের হলিউড ছবিতে ডাকসাইটে সুন্দরী বলতে যা বোঝানো হত( মূলত ফর্সা এবং ব্লন্ড), তা যতই আর্টিফিশিয়াল হোক না কেন, তার মধ্যে অ্যাফ্রো-আমেরিকানরা গণ্য হতেন না। আরও পরিষ্কার করে বললে কালো চামড়ার কেউ ‘ডিসায়ারেবল’ হতে পারেন না – এমনই একটা ভিত্তিহীন ধারণা সমাজে ঢুকিয়ে দেওয়া হল।  হালের হলিউড ছবিতে এই ধারণার বদল ঘটছে কিছুটা। এই বিভাজন এবং দমন রেস, জেন্ডার, ইকোনমি, রিলিজিয়ন আরও অনেক কিছুর ওপর নির্ভরশীল।

কালো রঙকে খারাপ বা নেগেটিভিটির সাথে অ্যাসোসিয়েট করে দেওয়া, এবং সাদাকে পবিত্র, ইনোসেন্সের সাথে অ্যাসোসিয়েট করে ফেলার ফলে, এই সহজ সমীকরণটা আর্কিটাইপের মত মাথায় গেঁথে গিয়েছে। এরফলে ২১ শতকে এসে এমন বর্ণবৈষম্য থেকে গিয়েছে। সাদাকালোর বাইনারিতে, সাদা প্রিভিলেজড এবং কালো উইকার এই নেতিবাচক কনসেপ্টটাই সমস্যার। চামড়ার রঙ উজ্জ্বলতার মাপকাঠি শুধু নয়, যোগ্যতার মাপকাঠি হিসেবেও গণ্য হয়েছে বহুবার। অন্তঃসারশূন্য “আমেরিকান ড্রিম”-এর ডিসকোর্সে, ইমেজ নামক একটা অদ্ভুত কনসেপ্ট আছে, সেই কনসেপ্ট অনুযায়ী মানুষ নিজের ইমেজকে ঠিক যতটা ভালোভাবে প্রোডাক্ট হিসেবে কনজিউমারকে কনজিউম করাতে অর্থাৎ সহজ বাংলায় নিজের ইমেজকে যতটা ভালো ভাবে বিক্রি করতে পারবে, ততই সে সাকসেসফুল হবে। যে পারবে না সেই এই ইঁদুর-দৌড় থেকে ছিটকে যাবে, এবং তার ব্যক্তিসত্ত্বাকে দুমড়ে মুচড়ে ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া হবে, যেমন উইলি লোম্যানের হয়েছিল আর্থার মিলারের দ্য ডেথ অফ আ সেলসম্যান নাটকে।  ঠিক এভাবেই হলিউডের ছায়াছবি সৌন্দর্যের মাপকাঠি ঠিক করে দিয়েছে, ইমেজ সেলিং-এর ওপর ভিত্তি করে। সময়ের সাথে সাথে ক্যাপিটালিজমের চাকা ঘুরতে থাকল। ক্যাপিটালিজম কনজিউমার চায়। তাই এই ক্যাপিটালিজমের প্রভাবে, বাজারনীতিতে ধীরে ধীরে একটা অদ্ভুত বদল ঘটল, সাকসেসফুল মানুষের পাশাপাশি, আনসাকসেসফুলদের ইমেজও বিক্রি শুরু হল এবং বুঝিয়ে দেওয়া হল যে এরা ব্যর্থ। শুরু হল ব্যর্থতার সংজ্ঞা দেওয়া।  দেওয়া হল উদাহরণ।  সফল মানুষের বৈশিষ্ট্যের পাশাপাশি, ব্যর্থ মানুষ কেমন হয়, তার চারিত্রিক গুণাবলীর একটা ভারী মিষ্টি লিস্টি তৈরী হল। এমন ইমেজ সেলিং না  থাকলে, ডোনাল্ড ট্রাম্প ইলেকশন জেতে না। একটু ভাবলেই দেখা যাবে সাদা মানুষের পাশাপাশি কালো মানুষদের ইমেজ সেল করে বারবার মানুষের মাথায় হ্যামার করে বোঝানো হয়েছে সমাজগতভাবে, অর্থনীতির দিক থেকে, রাজনৈতিকভাবে এবং কালচারালি সাদা চামড়ার মানুষরা স্ট্রং এবং কালো চামড়ার মানুষরা উইক। সহজ নিটোল সমীকরণ। বহু আমেরিকান ছবিতে ভিলেন হিসেবে বা ভায়োলেন্স করতে দেখা গেছে অ্যাফ্রো-আমেরিকানদের, ভারতে যেভাবে মুষলমানদের ইমেজ বিক্রি করা হয়েছে।

সময়ের সাথে সাথে এই ইমেজ-সেলিং কনসেপ্টের অমানবিক দিক সামনে চলে আসে। ক্রমেই হিউম্যানিস্টরা বুঝতে পারেন যে এই সমীকরণটা আসলে সুপারফিশিয়াল।  সাথে সাথে কালো চামড়ার মানুষদের প্রতি সহানুভূতি বর্ষণও শুরু হয় – যার মাধ্যমে বারবার ঘুরেফিরে সেই একই কথা বুঝিয়ে দেওয়া হয় যে কালো মানুষ আসলে দুর্বল। সাদা চামড়ার মানুষরা মহানুভব তাই তাদের স্বীকৃতি দিচ্ছে। কিন্তু তারা এই স্বীকৃতি দেবার কে? তারা বিচার করবেন কেন? আসলে আমেরিকার ইতিহাসের গোটাটাই রেসিস্ট। নেটিভ আমেরিকানদের সাধারণ সিলিভ রাইটসটুকু ছিল না। কালো চামড়ার মানুষ বলতেই তাকে নিয়ে চলত চুড়ান্ত অবজেক্টিফিকেশন। সেকেন্ড ওয়েভ ফেমিনিজম আবার বলতে শুরু করে যে শ্বেতাঙ্গ নারীদের চেয়েও কৃষ্ণাঙ্গ নারীরা অনেক বেশি অবদমিত। ফার্স্ট ওয়েভ ফেমিনিস্ট মুভমেন্ট থেকে শ্বেতাঙ্গ নারীরা যতটুকু সুবিধা পেয়েছিলেন, কৃষ্ণাঙ্গরা তা পান নি। শুধুমাত্র গায়ের চামড়ার পার্থক্যের জন্য একজন শ্বেতাঙ্গ নারীর থেকে আরেক ধাপ বেশি দমিত হন একজন কৃষ্ণাঙ্গ নারী। তাহলে কী দাঁড়াল? দাঁড়াল এই যে একজন কৃষ্ণাঙ্গ নারীকে পুরুষতন্ত্র শুধু নয়, বর্ণবৈষম্যের বিরুদ্ধেও লড়তে হয়। তাই ফেমিনিজমের ডিসকোর্সে কৃষ্ণাঙ্গ নারীদের রাইটস নিয়ে বক্তব্য রাখা শুরু হয়। ব্ল্যাক ফেমিনিজমও বলা হয়। তো সেই দাগ ঝেড়ে ফেলতে চায় সকলেই। এবং বিশ শতকের অ্যান্টি-রেসিজমের বিভিন্ন মুভমেন্টের চাপে পড়েই এই রাজনৈতিক আলিঙ্গন। ফলে, হঠাৎ কালো চামড়ার মানুষদের, এতদিন বাদে, ভাই বলে বুকে টেনে নিয়ে “আহাহা, বেচারা” বলাটা আসলে সমস্ত বিষয়টাকে পুনরায় একই বৈষম্যের গাড্ডায় এনে ফেলা বৈ অন্য কিছু নয়। এই সূক্ষ্ম রাজনীতিখানা ক’জনের চোখেই বা পড়ে।! বাই দ্য ওয়ে, অস্কার অ্যাওয়ার্ডস কিন্তু এমন রাজনীতির সবচেয়ে বড় প্রমাণগুলির একটি।  একটু লক্ষ্য করলেই বুঝবেন।

এত কথা বলছি কেন! বলছি কারণ এই একই জিনিস ক্রমাগত আমার দেশেও হচ্ছে। দলিত নিধন, সংখ্যালঘু নির্যাতন বা হালের এই এন.আর.সি এবং সি.এ.এ. এর বাইরে নয়। এই দেশের কেন্দ্রীয় সরকার এদের শিক্ষা নেই, ওদের কালচার নেই, এরা লিবটার্ড, তারা সেকুলার, ইউনিভার্সিটিতে ইক্যুয়ালিটি নিয়ে বক্তব্য রাখলে আর্বান-নক্সশাল, মার্ক্স নিয়ে বললে পাকিস্তান বা চিনের ভিসা বা গোলি মারো সালোকো বলে যে ন্যারেটিভগুলো বাজারে সেল করছে সেগুলোকে আসলে দায় ঝেড়ে ফেলা বলা হয়। এটাও একধরণের নেগেটিভ ইমেজ প্রচার করা।  সরকার আসলে ব্যর্থ। শিক্ষা পৌঁছে দিতে।  তার চেয়েও বড় কথা যে সরকার সামান্য বেসিক নিডগুলোর ব্যবস্থা করে দিতে পারে না, তাদের মুখে এসব মানায় না। যাইহোক, জাতপাত এবং রিলিজিয়নের নামে যে ন্যক্কারজনক ঘটনা আমাদের দেশে প্রতিনিয়ত হয় সেই নিয়ে কিচ্ছুটি ভাইরাল হয় না। রোহিত ভেমুলার মৃত্যু কী সহজে এড়িয়ে গেলো দেশ, কেন্দ্র এবং ব্যক্তি মানুষ! কে ঠিক কী খাচ্ছে সেটা জানতে এরা প্রায় বার দু’য়েক অন্যের পাকস্থলী ভ্রমণ করে। করোনার জন্য হওয়া লকডাউনের মধ্যেও এই ব্যবস্থা অব্যাহত। এমন কনসিসটেন্সি ভারতের ক্রিকেট দলে থাকলে ২০১৫ এবং ১৯, দুটো ওয়ার্ল্ড কাপই ঘরে আসত। ১১ই মে, ২০২০ তে নিউজ এইটটিনে পাবলিশ হওয়া একটা আর্টিকেল অনুযায়ী ৪ দিনে ৪ জন দলিতকে মেরে ফেলা হয়েছে।  আর্টিকেলটায় আরও বলা হচ্ছে, “Since the first nationwide lockdown began on March 25, there have been at least 30 major incidents of caste-based violence in the state, according to a study by Evidence.”

অবাক হবার কিচ্ছু নেই, এই দেশে প্রকাশ্য রাস্তায় গাড়ি চলে না, জ্যান্ত দলিত জ্বালানো হয়। কিন্তু  খবর হয় না। জাতের দোহাই দিয়ে উলঙ্গ করে মানুষ মারলে খবর হয়না। দিনের পর দিন কাশ্মীরে ইন্টারনেট বন্ধ করে রাখলে, দালাল মিডিয়া সেটাকে খবরে আনে না। তারা ভাবে তারা যেটা দেখাবে সেটাই খবর।  মজার বিষয়, সেটাই মানুষের কাছে খবর হয়। নেশান আসলে নেভার ওয়ান্টেড টু নো, হোয়াট ইজ রিয়্যালিটি। এসব নয় অনেক বড় বড় ব্যাপার। সামান্য বাড়িতে যিনি রান্না করেন বা বাসন মাজেন বা ঘর মোছার কাজ করেন তাঁকে খাটে বা সোফায় বসতে না দেওয়ার মত ঘটনাও আমাদের মত অনেক পরিবারেই হয়। তাহলে খবরটা হয় কী? খবর হয় রাম মন্দির, মোদীর কোর্টের দাম, মমতার ভুল উচ্চারণ।  তাই স্বাভাবিকভাবে এখানে মানুষ আমেরিকার মত গর্জে উঠতে পারে না। বিন্দুমাত্র ভেবেই তো দেখে না মানুষ। এই যে ক্রমাগত বিভাজননীতি সেটা যতটা শাসক চেয়েছে, ততটাই সাধারণ মানুষ গ্রহণও করেছে। এটার একমাত্র কারণ ডিভাইড অ্যান্ড রুল। যে নীতির মাধ্যমে গোটা পৃথিবীটা চলছে। সমস্ত জায়গায় এই বিভাজন ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে। লিঙ্গ বৈষম্য, ভাষাগত বৈষম্য, প্রাদেশিক বিবাদ, অর্থনৈতিক বৈষম্য ছাড়াও রয়েছে শিক্ষাগত বৈষম্য। লকডাউনের বাজারে এই শিক্ষাগত বৈষম্য দেখছি কোভিড-১৯ এর চেয়েও দ্রুত গতিতে মিউটেট করে ফেলল নিজেকে। অ্যাকাডেমিয়ার সাথে যারা যুক্ত আছে তাদের কতজন চেষ্টা করেছেন শিক্ষাকে অন্ধকারে নিয়ে যাওয়ার? আরে অ্যাটলিস্ট ভেবেছেন কতজন ? সবাই ধেই ধেই করে স্কাইপ, জুম ইত্যাদি খুলে অনলাইন ক্লাস করাচ্ছেন। আর যারা ক্লাস করতে পারছে না, তারা কী? কোল্যাটেরাল ড্যামেজ! তাহলে এই অ্যাকাডেমিয়া কাকে সার্ভিসটা দিল ভাই? যে অর্থ দিয়ে শিক্ষা কিনতে পারল তাকেই তো! তাহলে আর হলই বা কি! “ভারত আবার জগত সভায় শ্রেষ্ঠ আসন লবে” যে আসলে ভারতের অক্ষমতার ভাঙচুরকে ছাপাছাপা টেবিল ক্লথ দিয়ে ঢেকে ফেলা ছাড়া আর কিছুই নয়, এটা বোধহয় স্বয়ং গোমাতাও বুঝবেন।  সন্তানদের ব্যাপারে নয় নাই বা বললাম।

আমেরিকার মানুষ আর না পেরে ক্ষেপে গিয়েছেন। তারা বিষম ঝড়ের মধ্যে থেকেও মারের সাগর পাড়ি দিতে প্রস্তুত। আরও এক প্রস্থ লড়াই সিভিল রাইটসের জন্য। সাধারণ মানুষ থেকে তারকা তারান্তিনো সবাই পথে। সকলে মিলে কাঁধে কাঁধ দিয়ে রেসিস্টেন্স তৈরি করেছেন আমেরিকার এই সিস্টেমেটিক রেসিজমের বিরুদ্ধে। দ্য গার্ডিয়ান পত্রিকার একটি আর্টিকেলে বলা হচ্ছে, “The expendability of Black lives is not a flaw in the system; it is the system.” ভায়োলেন্ট প্রটেস্ট বলছেন কেউ কেউ। কিন্তু কুক্ষিগত করে রাখা অধিকার ছিনিয়ে নেওয়ার দাবী এমনই হয়। ইতিহাস তার সাক্ষী। আমেরিকার সর্বেসর্বা বোধহয় ভিয়েতনাম ভুলে গেছেন। সে ভুলে গিয়ে ভালো কাজ করেছেন, উনি মনে রাখলে বরং সেটা অস্বাভাবিক হত। তবে ট্রাম্পবাবুর খুব একটা চাপ নেই, গদি গেলে তিনি ফের ডব্লু ডব্লু এফ-এ চলে যাবেন। এখন শুনছি তিনি নাকি ভয়ে বাঙ্কারে গিয়ে উঠেছেন। নিভিয়ে দিয়েছেন হোয়াইট হাউজের আলো। এমনকি ট্রাম্পের পুলিশের একাংশ হাঁটু মুড়ে বিক্ষোভকারীদের সাথে সলিডারিটি জানাচ্ছে।  দ্য টাইমস অফ ইন্ডিয়ায় প্রকাশিত আর্টিকেলে বলা হচ্ছে, “Dana Wingert took a knee before a crowd of demonstrators along with other officers and explained it this way: “Us joining them in a symbolic way, that’s the least we can do.”এমন দৃশ্য আমার দেশে হবে না।  প্রথম কারণ ভারতের পুলিশ আর মানুষের অ্যাপেন্ডিক্স একই জিনিস। দুটোই কাজে আসে না অকর্মণ্য। আর দ্বিতীয়ত, আমার অভাগা দেশে মানুষকে নেতা-মন্ত্রীরা নয়, নেতা-মন্ত্রীদের মানুষরা ভয় পান। এতটাই মেরুদন্ডহীন মূর্খের দেশে বাস করতে হচ্ছে। না গিলতে পারছি, না ওগরাতে। এমন সব ক্ষমতালোভী কীটদের শাসনাধীন থাকতে হচ্ছে, যারা বন্দুক এবং মাথা নোয়ানো পাবলিক ছাড়া কিচ্ছু বোঝে না।  আমার দেশে এমন দিন দেখতে হয়ত আরও বহু বছর সময় লেগে যাবে অথবা হয়ত কখনও হবেই না। এই মূর্খ জনসমাজ থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন এলিট ভাবতে ভালো লাগে কিন্তু ভালো লাগলেই তো হল না। বাস্তবে এর দায় আমাদেরও। এভাবে নিজেকে জনবিচ্ছিন্ন প্রমাণ করার মধ্যে কিন্তু আসলে কোন আত্মগরিমা নেই, বরং এসকেপিজম আছে আর আছে সেই একই বিভাজনের রাজনীতি। তবে মাঝে মাঝে খবর পাই, কেউ এসে ঈদের হালিম খেতে ডাকে। কেউ বিশ্ববিদ্যালয়ের কোয়াডে বসে ঘন্টার পর ঘন্টা বুদ্ধের কথা বলে, কেউ এসে বলে খ্রীষ্টের কথা। কখনও কখনও তো মহাভারত, গুপ্তযুগ এবং তার ভগবতায়ন নিয়ে এক নাগাড়ে গল্প করতে করতে চাঁদ উঠে আসে আকাশে। কি আশ্চর্য! এই ইমেজ গুলো কখনও সেল হবে না। এই ইমেজগুলো আদতে সেল হবার নয়। এই ইমেজগুলো বিক্রি হলে, বাজারে যে ক’টা ইমেজ আপতত চলছে সবকটার ফাঁপা এবং ফাটা রবার বল ছাড়া কিচ্ছু নয় সেটা লোকচক্ষুর সামনে চলে আসবে। এলেই বিপদ। বিভেদ টিকিয়ে রাখা যাবে না। সংসদীয় গণতন্ত্রে বিভেদ টিকিয়ে না রাখলে, গদি টেকানো যায় না এই সার কথা বুঝে ফেলেছেন সমস্ত রাজনৈতিক দল। তাই এই ইমেজগুলোকে সামনে আনা যাবে না। কিছুতেই যাবে না। সেগুলো থাকবে গোপনে, নিরালায়। মনে রাখতে হবে, মিডিয়া কিনে, ভয় দেখিয়ে, পাকিস্তানে বোমা ফেলে, উরি নামক সিনেমা বানিয়ে ভুলিয়ে দিতে হবে যে ভারতের জিডিপির মাত্র ১% স্বাস্থ্যে খরচ হয়। মনে রাখতে হবে, ধর্মই আমাদের সব। তাই এমন কঠিন পরিস্থিতিতে ধর্মস্থানগুলিকে আগে খুলে দিতে হবে। হিউম্যান রিসোর্সের আগে, ক্যাপিটালিজমের চাকায় ক্রমাগত তেল ঢেলে যেতে হবে, তাতে শ্রমিক মরুক বাঁচুক, ডাজন্ট ম্যাটার। ক্যাপিটালিজমের এই লেবার অ্যালিয়েনেট করার পদ্ধতিই যে শ্রমিকের চরম দুর্ভোগের কারণ, সে ব্যাপারে কে বোঝায় ? কেই বা বোঝে?

তবুও অনেকেই এমন আছেন, যারা এখনও মানুষে বিশ্বাস করেন।  কেউ একজন বেশ বলেছিল, ক্ষুধার দেশে সকলের ইন্টারেস্টে একসাথে আঘাত লাগলে তবেই মানুষ পথে নামবে। দুঃখের এটাই যে এত ভেদাভেদ, এতো রক্ত-সফলতা, এতো বিদ্বেষ দেখার পর ভারতবর্ষের মানুষের মনে হচ্ছে এটা তাদের ইন্টারেস্ট নয়। এন.আর.সি. মুষলমানদের সমস্যা। ছোঁয়াছুঁয়ির সমস্যা তো আমাদের কী! ওই ছেলেটা খেতে পাচ্ছে না, আমাকে বাড়ি ফেরার সময় ফল কিনতে হবে। ওই মেয়েটাকে পড়তে দেওয়া হয়নি, তাতে কী? পড়ে কী করবে? বিয়ে দিয়ে দিক! এই তো দেশ। এই তো ভারত।  তবুও কোন একটা ইন্টারেস্টে একসাথে ঘা লেগে বিপ্লব হবে বলে অনেকেই বিশ্বাস রাখছেন। রাখুন। ভারত সেই স্বর্গে ঠিক জাগরিত হবে এই নিয়ে তাদের দিনযাপন। তাদের বিশ্বাস অক্ষয় হোক। তাদের বিশ্বাস লড়াই হয়ে ঝরে ঝরে পড়ুক।

ইনকিলাব।

Source:

https://www.news18.com/news/india/4-dalits-killed-in-4-days-activists-say-upper-castes-in-tn-using-lockdown-as-opportunity-for-assaults-2615511.html

https://www.theguardian.com/commentisfree/2020/jun/03/america-black-deaths-racism

https://timesofindia.indiatimes.com/world/us/police-stun-americans-by-taking-a-knee-with-protesters/articleshow/76166865.cms.html

Leave a comment