অফিশিয়ালি বসন্ত চলে গিয়েছে। কিন্তু মন থেকে বসন্ত চলে যায় নি- যায় না। গত বসন্তের সেই স্মৃতি গুলোকে এক করে রাখার ইচ্ছে হল হঠাৎ তাই, ফেসবুকে দেওয়া এই লেখাগুলোকে একত্র করে ব্লগে দিলাম।
১.
ভালো এবং খারাপ এই দুটি অদ্ভুত অনুভূতি, আড়াআড়ি দুটি গোলার্ধে পৃথিবীকে ভাগ করে দিয়েছে। বিষুবের মত এর কোন স্পষ্ট বিভাজিকা নেই কারণ ভালো মন্দ সবটাই আপেক্ষিক। আপেক্ষিক বলেই এরা সাধারণ নয়। আমাদের বেড়ে ওঠার সাথে সাথে বিভাজিকা তার স্থান বদলে ফেলে, তাই ভালো-খারাপের মধ্যে এক অদ্ভুত স্থৈর্যচ্যুতি দেখা যায়। আমরা বুঝতেই পারিনা, ঠিক -ভুলের ফারাক। আমার ক্ষেত্রেও বিভাজিকার স্থান বদলে ফেলা পালটে যায়নি। সে রোজ বদলাচ্ছে। শেখাচ্ছে। আমৃত্যু বদলে যাবে।
সম্পর্ক আসে আর যায়। চট করে তৈরি হয়, ভাঙেও। খুব কম স্থায়ী হয় আর বাকিরা আততায়ী। বসন্ত আর মানুষ কি ভয়ঙ্কর বিশ্বাসঘাতক, না ?
রচনাকাল : ৩০ শে জানুয়ারি
২.
আজকে বাবা হেব্বি খুশি। তার শখ করে কিনে আনা শান্তিনিকেতনের পলাশ চারা বিশাল আকার ধারণ করেছে আর এই বসন্তে সে প্রসব করেছে লাল ফুল। আমগাছের তলায় দাঁড়িয়ে যখন পলাশ গাছের একদম চুড়ায় তাকাই তখন দেখা যায় ওই ফুলেদের। বিকেলে ঝরে পরেছিল তাদের মধ্যে থাকা দু-খানি ফুল শান বাঁধানো উঠোনে। বাবা ওদের নিয়ে এসে আমার কম্পিউটার টেবিলে রেখে চলে গেল নাটকের রিহার্সালে, সাইকেলে চেপে রবীন্দ্র সঙ্গীত গাইতে গাইতে। বাবার মন খুব ভালো আছে আজকে।
অবসরের সময়ে বাড়ি বসে পিয়ানো বাজাতে বাজাতে যে মানুষ ক্লান্ত হয়ে গিয়েছে, তাঁকে যৌবন রঙে উদ্দীপ্ত করছে কয়েকটা ফুল। প্রকৃতির সাথে মানুষের গভীর অথচ কখনও-না-দেখা সম্পর্কগুলো এমন ছোট ছোট আনন্দই চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়। এদের মধ্যে কোন বিজয়ীর শক্তিরূপ নেই, প্রেমিকের মুক্তিরূপ আছে।
রচনাকাল : ১৭ই ফেব্রুয়ারি
৩.
বাইরে দেদার হাওয়া। ছাদে দাঁড়ালে শ্যাম্পু করা চুল উড়ে যাচ্ছে পশ্চিমে। আমের মুকুল আর অন্তঃসত্ত্বার জঠর-গন্ধের কি মিল! সুদুর মন্টিনেগ্রোর উঁচু টিলার ওপর খেলতে থাকা ছোট্ট মেয়ের গাল ছুঁয়ে যাওয়া হাওয়ার জন্যই এই দূষিত পরিবেশেও পলাশ ফোটে। ওরা ঝরে গেলে, যে আলতো করে, আঁচলে তুলে নেয় ওদের , সে মেয়েটির কোমল গাল ছুঁতে পারছে বুঝি। লাহোরের সদ্য যৌবনে পা রাখা মেয়েটির স্কুল যাওয়া যারা বন্ধ করে দিয়েছে, তারা কখনও নদী দেখেনি। মধ্যগতীতেই নদী সবথেকে সুন্দর অশ্বখুরাকৃতি হ্রদ তৈরি করে। ইসলাম, তুমি তাকে অশিক্ষার বাঁধ দিয়ে আটকে রাখছ! হুম? তোমার মঙ্গল হোক।
এমন অবস্থায় কবি আর তার বন্ধু রাস্তায় বেরিয়েছে সাইকেলে চেপে। তাদের ফিনফিনে পোশাক ফুঁড়ে যাচ্ছে বসন্ত, কোন এক শূন্যস্থান পূর্ণ করবে বলে। এ পৃথিবীতে ভ্যাকিয়ুম বলে কিচ্ছু নেই। কিচ্ছু হবেওনা। কবির রাইটার্স ব্লক চলছে বলে ধারণা করছে তার সখার। যদি তাই হয় তবে, এই সুবিশাল হৃদয়-ভ্যাকিয়ুমকে ভরাট করে দেবার জন্য আগ্নেয়গিরির মত ফুঁসে উঠে আসছে না কেন লেখারা ? ফুঁসে না উঠলেও, টুকরো লেখনী তো ছিটকে আসতেই পারে। সখা বলছেন, অন্তঃসত্ত্বার কখনও ঋতুস্রাব হয় না। এই বসন্তের রাইটার্স ব্লক সযত্নে লালন করছে লেখা, জঠরে। তারা সময় বুঝে বেরিয়ে আসবে ঠিক। চোখ বুজে থাকা রক্তাক্ত অথচ সাবলীল শিশুর মত।
রচনাকাল : ২১শে ফেব্রুয়ারি
৪.
এমনি এক ইজিপ্সীয় বিকেলে, ভারতের কোন এক অজানা পথে একগাদা ফুল ছড়িয়ে গেছে কেউ। গ্রামের মাঝখান থেকে গিয়েছে এই পথ। এক্কেবারে সোজা। অজানায়, আগেই বলেছি।ধুলো মাড়িয়ে আসছে কেউ বা কারা। কাঠের দোলনায় শুয়ে সেই বুটের শব্দ শুনতে পাচ্ছে সদ্যোজাত। স্পষ্ট শব্দ। খটখট খটখট। শব্দগুলো আরও স্পষ্ট হচ্ছে। মনে হচ্ছে শব্দেরা হাঁটছে না, ছুটছে। সে দৌড় উর্দ্ধশ্বাসে প্রাণ বাঁচানোর জন্য নয় বরং তা জয়োদ্ধত, দাম্ভিক।
এতোগুলো পায়ের শব্দ শুনে বাড়ির বাইরে বেরিয়ে এসেছিল যারা তারা দেখতে পাচ্ছে, বন্দুক হাতে একদল মানুষ কুচকাওয়াজ করতে করতে সেই অজানায় মিশে যাওয়া পথ ধরে এগিয়ে চলেছে। তেরো বছরের মৃণ্ময়ী-কে, সেই দোনলাধারীদের মিছিলের সামনের সারির কয়েকজন খারাপ চোখে দেখছিল। তার মা বাদে কেউ সেদিকে খেয়াল করেনি। সে নিজেও না। তারপর, সেই বন্দুকধারী, কুচকাওয়াজরত মানুষের দল রাস্তা জুড়ে ছড়িয়ে থাকা একগাদা ফুলেদের দলে দিয়ে চলে গেল। ওরা চলে যাবার পর মৃন্ময়ী সেই নষ্ট হয়ে যাওয়া ফুলেদের কাছে গেল এই ভেবে যে, যদি কেউ টিঁকে থাকে এই নারকীয় নিষ্ঠুরতার পরও। কিন্তু দুঃখের বিষয় তাদের কেউ অক্ষত ছিল না। কেউ না।
চাঁপা ফুলের ভাগ্যটাই এমনি হয়। না ?
২৮শে ফেব্রুয়ারি,২০১৭
৫.
ভাঙা মন শুনেছিলাম পৃথিবীতে সবচেয়ে সুন্দর ও সাবলীল। আমার বাড়ির ব্যলকনি বেয়ে যে মালতীলতার গাছটি রয়েছে, সে উলটো দিকে চেয়ে থাকলে পশ্চিমে বেঁকে যাওয়া পথটিকে দেখতে পায়। সে পথকে আমি ছোট থেকে বড় হতে দেখেছি। সামাজিক কারণে তার ওপর ভাঙচুর চলেছে কিন্তু তাকে তার কাজ থেকে বিচ্যুত হতে আমি দেখিনি কখনও, অগুনতি আলোকবর্ষ ধরে সে পথিকের ইন্সপিরেশন হয়ে ছিল। আজও আছে। পথে জল জমে বলে তার ওপর ফের চলছে ভাঙচুর। চারিদিকে ধুলো উড়ছে। পথের এখন দমবন্ধ পরিস্থিতি। এ বসন্তে সে শ্বাস নিতে পারছে না ঠিক করে। কর্কট রোগের মত তার ওপর আছড়ে পড়ছে দুমুখো কোদাল। বিকেলে ফেলে গেছে ইঁট, কারা যেন তার বুকের ‘পরে। ধূলিমলিন পথের শরীর, সে মৃতপ্রায় বা হয়ত মৃতই।
আমাদের গাছে এক থোকা পলাশ থেকে তিনটি এসে পড়ল তার বুকের ওপর। এ পথের নতুন জন্ম হবে। বাংলার রাজনীতি পথের জন্মাতর ঘটিয়ে এসেছে বারবার। তবে ওই তিনটি পলাশ নতুন পথের জন্মদিনে গুলদস্তা সাজিয়ে শুভেচ্ছা জানাচ্ছে না, সে খুব সনাতনী কায়দায় যেন পুরনো পথের গোরের ওপর, এ বিশ্বের যাবতীয় নান্দনিকতা বিছিয়ে রেখে শুকিয়ে যাচ্ছে। খুব করে শুকিয়ে যাচ্ছে।
শিশির, ওকে প্রাণ দেওয়ার বৃথা চেষ্টা বন্ধ করো না।
রচনাকাল : ১লা মার্চ, ২০১৭
এবং ৬.
এমন ভালোলাগার বসন্তে দাঁড়িয়ে পৃথিবীর কিছু অর্থহীন সীমানায় যুদ্ধ চলছিল দেদার, যুদ্ধবাজের মদতে। সৈন্য মরছিল। মৌলবাদীরা ফেটে পড়েছিল পারমাণবিকে উচ্ছ্বাসে। আশেপাশের আকাশ গুটিয়ে নিচ্ছিল নীল। সীমান্তে কিংশুকের পাতা ধুলোময়ী তখন। সে ধুলোর মধ্যে থেকে উঁকি দিচ্ছে ফুলেরা। আহত সৈন্য হেলান দিয়েছিল সে গাছে। তার শ্বাস পড়ছিল খুব জোরে। উত্তুরে হাওয়া বয়ে আনছিল শীত উপত্যকার কাছ থেকে। গাছের কষ্ট হচ্ছে খুব। সে চেষ্টা করছে সৈন্যটির মন ভাল করে দেবার।
সৈন্য মারা গেলেন পরের দিন। সেনা ছাউনি থেকে বাহিনী এসে দেখল, রক্তে ভেসে গিয়েছে তার শরীর। বুকের বারুদে-ফুটো হা করে চেয়ে আছে। তারা দেহ নিয়ে চলে গেল। গতরাত্রে কিংশুকের দল খুব চেষ্টা করেছিল সৈন্যকে বাঁচাবার। সৈন্যের ধমনী বারবার শুষে নিয়েছিল ওঁদের লাল। কিংশুকের শেষ ফুলখানি ঝরে পড়ল মৃত্যুর এই সন্ধ্যায়। একরাতের মধ্যে অতগুলো ফুল ঝরে পড়া খুব অস্বাভাবিক এবং বসন্তের দিনে ভীষণ অনভিপ্রেত হলেও তা ঘোর বাস্তব।
সেই বসন্ত রাত্রির পর থেকে গাছটি চিরতরে বন্ধ্যা হয়ে গেল, না কোন সালোকসংশ্লেষের অভাব বা অত্যাধিক বারুদে আবহাওয়ার কারণে নয়, মৃত্যুর দুঃখে; যুদ্ধের গ্লানিতে; অপঘাতের ব্যাথায়।
রচনাকালঃ ১৯শে মার্চ, ২০১৭
সুন্দর মন বিকশিত হোক আরও আরও …
LikeLiked by 1 person
শালা, বারবার পড়তে হয় এগুলো
LikeLiked by 1 person
এর মধ্যে একটা লেখা একজন ঝেঁপে, হোয়াটস অ্যাপে পাঠাচ্ছে; আমার হোয়াটসঅ্যাপে এসেছে। 😛
LikeLike
“পারমাণবিক উচ্ছাস” – খুব শক্তিশালী শব্দবন্ধ। লেখাটি পড়ে মনে পরে গেলো ফায়ারিং স্কোয়াড এর সামনে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ কবি, মুষ্ঠিবদ্ধ হাত, চোখে স্বপ্ন লেগে আছে বিপ্লব আর সমুদ্রের। মনে পরে গেল এক অভিমানী তরুনের কথা যে তীব্র আশ্লেষে কবিতা লেখা ছেড়ে সমুদ্রযাত্রা করলো হয়তো কবিতাকে বেশি ভালোবাসতো বলেই। কলম দীর্ঘজীবী হোক। অমরত্ব পাক স্বপ্ন।
LikeLiked by 1 person