বিয়েবাড়ির রোশনাই এসে পড়েছে আমাদের উঠোনে। শ্রীতমাদির বিয়ে। আমারও নেমন্তন্ন আছে। সন্ধ্যে সাড়ে আটটা নাগাদ বগলে গিফট দাবিয়ে বাড়ি থেকে বেরোতে হবে। আমি শেষ মুহুর্তে র্যাপ করে নিচ্ছি গিফটটা। বাইরে বসন্তের হাওয়া নেই তেমন। শীতে যে বাদাম গাছের পাতাগুলো ঝরে গিয়েছিল, তাতে পাতা এসেছে, খেয়াল করিনি। ল্যাম্পপোস্টের হলদে নিয়নে পাতাময় গাছটির অবয়ব বিলকুল ঠাকুমার শোনানোর ভূতের গল্পে থাকা ব্রহ্মদৈত্যের বাস-বৃক্ষের মতো লাগছে। বাদাম গাছকে ডান হাতে রেখে আমি আর মা চলেছি বিয়েবাড়ি। সুন্দর সাজানো লজের ভেতর ফুচকাওয়ালা বসেছে একসাইডে। ফুচকার সাথে বাঙালির প্রেমটা অনেকটা ভিড় ট্রেনে দেখা সেই মেয়েটার মত, যার এলো চুল এসে ছুঁয়ে যায়, ক্রীমহীন গাল। দুই প্রেমই ক্ষণিকের, একটু বেশি হলেই অম্বল। সে যাহোক, ফুচকার দুর্বলতা এড়াতে না পেরে প্রথম ফুচকাটা মুখে দিয়ে মনে হল, বিশ্ব-উষ্ণায়নের এই বাজারে একমুঠো চিলেকোঠামুখী শীতল হাওয়া যেন আমার মাথার চুলে বিলি কেটে দিচ্ছে।
লজের দোতলায় খাওয়া-দাওয়া। পাতে প্রথমেই এসে পড়েছে নান সাথে কাবলি ছোলার প্রিপারেশন। এ দুটো শেষ করে যখন সবেমাত্র ফিস ফ্রাইতে স্বাদ-কামড় বসিয়েছি, দেখি শ্রীতমাদি এসেছি ফর্ম্যালিটি করতে। শ্রীতমাদির বাড়িতে অনেক লোক, বিয়ে ছেড়ে সে “রান্না ভাল হয়েছে ?”, “কাকু, চেয়ে খেয়ো কিন্তু…” এসবে ব্যস্ত কেন দেখে অবাক হলাম একটু। একজন তো বলেই বসল, “বাবা আধুনিকতার বহর দেখো, নিজের বিয়ে কোথায় লজ্জা পাবে তা নয় এসব করছে!” ডেসার্টে একটা দুরন্ত কাস্টার্ড ছিল। সেটার অমৃতসমা স্বাদ জিভে মেখে, সিঁড়ি ভাঙতে ভাঙতে নিচে নেমে এলাম। দেখলাম শ্রীতমা দি এখনও বিয়েতে বসেনি। মা গিয়ে জিজ্ঞেস করল “ব্যাপার কি?” শ্রীতমা দি উত্তর দিল, “কিছুই না। বর এলেই বসব”।
বাইরেটা বেশ ঠাণ্ডা, হাওয়ায় বকুলের গন্ধটাকে খুব মিস করছিলাম। বাইরে বেরিয়ে এসে মা কে বললাম “বিয়ে কখন হবে?” মা বলল, “মাঝরাতে লগ্ন মনে হয়”। আমরা কখনও বিয়ের কার্ডে লগ্নের সময় দেখিনা, দেখলেও মনে থাকে না হয়ত। এক্ষেত্রেও ব্যতিক্রম নয়, তবুও আমার কেমন খটকা লেগেই থাকল। শ্রীতমাদির বাবা, মা, ভাই কাউকে দেখলাম না কেন খাবার সময় বা খাবার পরে? মা-দের নাকি বিয়েতে থাকতে নেই, কিন্তু বাবা আর ভাই? ওদের তো নিষেধ নেই। বসন্ত খুব চঞ্চল। কোন ভাবনা দানা বাঁধতে দেয়না।
পরের দিন ভোরে আমি আর শ্যাম দা আড্ডা দিতে বেরিয়েছি। দেখি অনির্বান বসে আছে চায়ের দোকানের সামনে। মুখ চোখ বসে গিয়েছে, মনে হচ্ছে যেন রাতে ঘুমোয় নি। এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম “কিরে ? কাল দেখলাম না কেন বিয়েতে ?” অনির্বান কখনও কোন কিছু লুকোয় না আমার কাছে, তবে আজকে কেমন একটা ইতস্তত করছিল যেন। হয়ত শ্যাম দাকে দেখেই। অনির্বান আমাকে টেনে নিয়ে এলো সাইডে। তারপর বলল, “শান্তনুদার অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছিল রে। বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডে। স্পট ডেড। আমরা সবাই গিয়েছিলাম মর্গে। অনুষ্ঠান বন্ধ করব ঠিক করলাম কিন্তু সবাইকে ইলেভেনথ আওয়ারে খবর দেওয়া সম্ভব নয়। যারা চলে আসবে তাদের কতবার করে বলব বলত যে শান্তনু দা নেই। দিদি বলল, এতো লোককে নেমন্তন্ন করেছি, না খেয়ে যাবে? দিদির জেদ তো তুই জানিস। ওই অবস্থায় কি করা উচিত বুঝতে না পেরে ওঁকে না করতে পারিনি। জানিস সবাইকে হেসে হেসে জিজ্ঞেস করেছে যে কেমন রান্না হয়েছে? কেমন আছেন ?… হাত পেতে গিফট নিয়েছে।…” অনির্বানের পরের কথাগুলো আমি শুনতে পাইনি। আমার মাথা ভোঁভোঁ করছিল। মিহিদানার মত হাল্কা ঠাণ্ডা সকালে, সত্যের সবচেয়ে কঠিন রূপ এমন আঘাত আনতে পারে আমার জানা ছিল না। অনির্বানের কাঁধে হাত রাখার বোধটুকুও আমার চলে গিয়েছিল বোধহয়।
ও হ্যাঁ, বলতেই ভুলে গিয়েছি, শান্তনুদা হল শ্রীতমার দির না হয়ে ওঠা বর আর অনির্বান শ্রীতমাদির ভাই।
এটা পুরো অন্যরকম লেখা। মুক্তগদ্যের মাঝখানে ছোট্ট ফিকশন। জিও ক্ষ্যাপা!
LikeLiked by 1 person
love you..
LikeLike
চূড়ান্ত লাগলো ভাই
LikeLiked by 1 person
ধন্যবাদ
LikeLike
eta onno rokom… notun jinis!
LikeLiked by 1 person
ভায় ❤
LikeLike
“বসন্ত খুব চঞ্চল। কোন ভাবনা দানা বাঁধতে দেয়না।”- এই লাইনটা দারুন লাগলো, আর এই লেখাটা বেশ অন্যরকম ভালো লাগলো…আরও চাই এরকম
LikeLiked by 1 person
Tor lekha ta onekta Biyebarir khabar dabarer list e Fish Butter Fry er moto. Main course er eligible noy kintu jodi bhalo banay loke fried rice/biriyani kom kheye otai 2 to beshi khay. Khub bhalo. Erokm khuchro, bhashar halka haturi diye hana lekhagulo tor kach theke pawata unexpected kintu tao impact rakhte baki rakheni.
LikeLiked by 1 person
bojho kaando
LikeLike
লাব্বিউ
LikeLike
dhonyobaad bandhu
LikeLike
অসম্ভব রকম অসাধারণ… 👌👌
LikeLiked by 1 person
স্বকীয়তা তোর (তুই করেই বললাম) নিজস্ব বৈশিষ্ট্য. তবে এটা অন্যরকম পরিবেশন ছিল. ঘটনা টি খুবই কষ্টদায়ক এবং সবচেয়ে দুঃখের যে এরূপ ঘটনা বিরল নয় … রোড অ্যাক্সিডেন্ট … চরিত্রবর্ণনাও খুবই সাবলীল … তবে তোর ফুচকা আর বাদাম গাছে দৈত্য টাচটা নিজস্ব ভঙ্গীমা …
LikeLiked by 1 person
থাঙ্কু থাঙ্কু
LikeLike